চাঁদপুরে মতলব ও ফরিদগঞ্জের দু’টি সেচ প্রকল্পে পানির অভাবে ১৬’শ একর ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ॥ মাটি ফেঁটে চৌচির

চাঁদপুরে মতলব ও ফরিদগঞ্জের দু’টি সেচ প্রকল্পে পানির অভাবে ১৬’শ একর ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ॥ মাটি ফেঁটে চৌচির

আবু নছর,চাঁদপুর প্রতিনিধি:
দেশের অন্যতম বৃহত্তম চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তরের মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পে পানির অভাবে গোয়ালভাওর এবং রাঢ়ীকান্দি বিলের প্রায় একশ’ একর জমির রোপা ইরি বিনষ্টের পথে। ফলে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে ওই এলাকার কৃষকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এবং পানি না পাওয়ায় প্রতিবাদ জানান।

কৃষকদের অভিযোগ, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই এমন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তারা। অন্যদিকে একই কারণে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের আওতাধীন ফরিদগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ১৫’শ একর জমির বোরো ফসল বিনষ্ট হতে চলেছে। খাল খনন না করায় ও ফরিদগঞ্জ -চান্দ্রা সড়কের গাজীপুরও চান্দ্রা এলাকায় দুটি ব্রিজের কাজ চলায় সেচের পানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায় এ ঘটনা ঘটেছে।

সরেজমিনে মতলব উত্তরে গিয়ে দেখা গেছে, ইরি-বোরো মৌসুমে রোপা ইরি ধান ক্ষেতে এখন ভরপুর পানি থাকার কথা। কিন্তু গোয়ালভাওর এবং রাঢ়ীকান্দি বিলে পানি তো দূরের কথা, ধান ক্ষেতের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। সেচ ক্যানেলেও পানি নেই। ধান গাছ লালচে রং ধারণ করে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকছে। এ দৃশ্য দেখে ফুঁসে উঠেছে কৃষকরা। এ অঞ্চলের মানুষ কৃষি নির্ভর। তারা মেঘনা-ধনাগোদা পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির পানি দিয়ে ইরি-বোরো মৌসুমে ধান আবাদ করে থাকে। কিন্তু এবার এই প্রথম পানি সঙ্কটে পড়েছে কৃষকরা। গোয়ালভাওর বিলে প্রায় ৫০-৫৫ একর এবং রাঢ়ীকান্দি বিলে প্রায় ৫০-৬০ একর জমির ধান এখন বিনষ্টের পথে। তবে কিছু কিছু ক্ষেতে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

গোয়ালভাওর গ্রামের কৃষক তৈয়ব আলী প্রধান বলেন, পাউবো পানি না দেয়ার কারণে আমার এক কানি (৪০ শতাংশ) ক্ষেতের ধান নষ্ট হওয়ার পথে। গত ২০-২৫ দিন আগে থেকেই পানি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে পাউবো। এ মৌসুমে আর ধান ঘরে তুলতে পারব না। কৃষক জসিম সরকার, দর্জি আবুল হোসেন, টিপু সুলতান, জিলানী সরকার ,জালাল তালুকদার, মনির মিয়াজী, নিজাম তালুকদার, সেরাজল হক ও মুছা প্রধানসহ একাধিক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, পাউবো কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে আমাদের রোপা ইরি মৌসুমে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে রাঢ়ীকান্দি বিলে গিয়েও দেখা যায় একই দৃশ্য। গোয়ালভাওর বিলের মত পানি না পেয়ে নষ্ট হওয়ায় ধান ক্ষেত এখন গো খাদ্য পরিণত হয়েছে। জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ফলে ওই বিলের সকল ক্ষেতই এখন বিনষ্টের পথে।

শাপলা পানি ব্যবস্থাপনা অ্যাসোসিয়েশনের (ইউ-২১ ক্যানেল) সিনিয়র সহ-সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, এবার পানি দিতে গিয়ে কয়েকবার সেচ ক্যানেল ভেঙ্গেছে। এ নিয়ে ডিপার্টমেন্টের সাথে কয়েক দফা তর্ক হয়েছে। তারা ক্যানেল ঠিক করার কথা শুনতেই পারছেন না। ক্যানেল ঠিক করাও হয় না। কৃষকরা পানিও পায় না। আমাদের কথা পাউবো কর্তৃপক্ষ বুঝতে চায় না।

মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের পানি ব্যবহারকারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সরকার মোঃ আলাউদ্দিন বলেন, ইউ-২১ সেচ ক্যানেলটি ১৯৮৮-৮৯ সালে নির্মিত হয়েছে। ৩০ বছরের পুরানো ক্যানেলে পরিমাণ অনুযায়ী পানি ছাড়লেই ক্যানেল ভেঙ্গে যায়। তাই টার্ন আউট ৩ ও ৪-এর শেষ সীমানা পর্যন্ত পানি পৌঁছাতে সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যথাযথ চেষ্টা করছি।

মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের এসও আব্দুল আজিজ বলেন, টার্ন আউট দিয়ে গোয়ালভাওর ও রাঢ়ীকান্দি বিলে পানি পৌঁছাতে হলে ইউ-২১ ক্যানেলে অনেক চাপ পড়ে। কারণ টার্ন আউটের চেয়ে ইউ-২১ ক্যানেল অনেক নিচু। ফলে এ মৌসুমে একই স্থানে ৪ বার ক্যানেল ভেঙ্গেছে। তবে ৪ টি টার্ন আউট ক্যানেলে রোটেশন অনুযায়ী পানি ছাড়লে কৃষক পানি পাবে। আমার জানামতে তারা রোটেশনে পানি নিতে চাচ্ছে না। মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের পানি ব্যবহারকারী ফেডারেশনের কমিটিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই এসব হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।

এদিকে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের আওতাধীন ফরিদগঞ্জ উপজেলার উত্তর-পুর্বাঞ্চলে সরেজমিনে দেখা যায়, পানির অভাবে বোরো ক্ষেতে ফাটল দেখা দিয়েছে। অনেক ক্ষেতের ধান গাছ মরে গিয়েছে। প্রতিটি কৃষকের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। কৃষকরা জানান, এবার সেচ দিতে না পারায় গাজীপুর, পালতালুক, উপাদীক, কড়ৈতলী ও শাশিয়ালী, বালিথুবা, শোশাইচর, মানিকরাজ, দেইচর, মুলপাড়া, ইসলামপুর, রাজাপুরসহ বেশ কিছু গ্রামের সেচ এলাকায় পানি সরবরাহের খাল গুলো খননের অভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ায়,পানি উন্নয়ণ বোর্ড মূল ডাকাতিয়া নদীতে পানি সরবরাহ করলেও সেচ প্রকল্প এলাকার কৃষকরা পানি পাচ্ছে না। ফলে, প্রায় ১৫শ’ একর জমিতে আবাদ করা বোরো হুমকির মুখে।

কৃষক মো: সফিউল্যা তপদার, বলেন তার প্রায় ৭০ একর জমির বোরো চাষাবাদ পানির অভাবে এই বছর বন্ধ রয়েছে। এর সাথে চলতি মৌসুমে একই এলাকার স্কীম ম্যানেজার মো: মাহবুব ভুঁইয়ারও ৫০ একরের পানির অভাবে বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রায় শতাধিক কৃষি জমির মালিক ও চাষী তাদের জমিতে কোনো ফসল ফলাতে না পারায় তাদের পরিবারের সদস্যদের সারা বছরের খাদ্য সংকট পড়ার অশঙ্কায় রয়েছেন।
সেচ এলাকার দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ণ বোর্ডের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দীন বলেন- আমরা বছরের শুরুতে ডাকাতিয়া নদীর মাধ্যমে সেচ এলাকায় পানি সরবরাহ করেছি, খল খননসহ কিছু কৃত্রিম সংকটের ফলে সঠিক সময় বোরো চাষিদের কাছে পানি না পৌছার কারণে কৃষকদের আজ এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার, মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জানান বোরো চাষের শুরুতে সেচের পানি সরবরাহের খালের উপর ব্রীজের কাজ করার সময় পানি চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি হয়। আমরা তাৎক্ষণিক লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবগত করলে, বিকল্প ব্যবস্থায় পানি সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া, দীর্ঘদিন যাবত সেচের খালগুলো বিএডিসি খনন না করায় পানি চলাচলে মারাত্মক বাঁধা সৃষ্টি হয়। আমাদের লোকজন আপ্রাণ চেষ্টা করেছে কৃষদের যেন বোরো চাষে কোন সমস্যা না হয়।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ.এইচ. এম মাহফুজুর রহমান বলেন, বিষয়টি জেনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে মোটামুটি বেশ কিছু এলাকায় বিকল্প ব্যবস্থায় পানি সরবরাহ করার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া, বোরো চাষকৃত এলাকায় গিয়ে পানি চলাচলের বাঁধাগুলো সনাক্ত করে ইউপি চেয়ারম্যান ও ব্রীজের কাজ যে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান করছে তাদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment